প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে রিপোর্টিং

ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মোবাইলে রোগীর ‘গোপন তথ্য’

প্রতিনিধি
বিশেষ প্রতিনিধি
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বের হলেই রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই কাজটি করছেন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা। নিজ প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লেখাতে চিকিৎসকের কাছে অফার-উপহারও পৌঁছে দেন তারা। এ কারণে মানহীন ওষুধ লেখার অভিযোগও কম নয়।

প্রেসক্রিপশনে রোগীর বিশেষ করে নারী রোগী গোপনীয় তথ্যসহ নানা নির্দেশনা থাকে। অনেক সময় পারিবারিক তথ্যও থাকে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির চ্যাটিং গ্রুপসহ বিভিন্ন জায়গায় তা আপলোড করা হয়।

রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারগুলোতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের এই দৌরাত্ম্য এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের কোথাও রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা তো দূরের কথা, চিকিৎসকদের উপহার দেওয়ার সিস্টেমও নেই। ওষুধ প্রশাসনের নীরবতায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

যদিও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির দাবি, এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর অবস্থানে তারা। অনৈতিক চর্চার কারণে ৩০-৪০ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে বলে জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। উপহার সংস্কৃতি বন্ধে সুপারিশসহ নীতিমালা জমা দিয়েছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক দেখানোর পরে বেরিয়ে আসা নাইমা বলেন, তারা (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) যেভাবে বারবার বলে না দেখিয়ে কোনো উপায় নাই। একজন কাগজ (প্রেসক্রিপশন) দেখতে চাইল। পরে দেখি আরও কয়েকজন মিলে ছবি তুলতে শুরু করেছে।

হাসিনুর নামে আরেকজন বলেন, আমি প্রথমে মনে করেছিলাম তারা হাসপাতালের লোক। এজন্য প্রেসক্রিপশনটা ওদের হাতে দিলাম। পরে শুনি তারা হাসপাতালের কেউ না। ওষুধ কোম্পানির লোক।

এদিকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, ছবি তোলায় তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী তারা প্রেসক্রিশনের ছবি তুলে তাদের চ্যাটিং গ্রুপ বা উপরের কর্মকর্তাদের পাঠান। অফিসের বাধ্যবাধকতা থাকায় বাধ্য হয়েই তাদেরকে এসব কাজ করতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, কি করব ভাই, আমরাও তো চাকরি করি। চাকরি বাঁচানোর জন্য আমাদেরকে বাধ্য হয়ে এসব কাজ করতে হয়। প্রেসক্রিপশনের ছবি না পাঠালে অফিস থেকে ঝাড়ি খেতে হবে।

আরেক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখল কি না সেটা যাচাই করতে এবং অফিসকে দেখাতেই আমাদের ছবি তুলে পাঠাতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জেনারেল ডা. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তারা (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) যেন হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে না পারে, রোগীদের হয়রানি না করতে পারে, এ জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেসক্রিশনের ছবি তোলার নামে এভাবে হয়রানি করা, তাদের গোপনীয়তা নষ্ট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোভের ফাঁদে পড়ে ডাক্তাররাও নিম্নমানের ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিচ্ছেন। এতে সবদিক থেকে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বিশ্বের কোথায়ও, আমি বলব, ডাক্তারদের ঘুষ দিয়ে প্রভাবিত করার নিয়ম নাই। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এই সিস্টেম নাই। শুধু আমাদের দেশেই এই সিস্টেম চালু আছে। ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের গিফট দেওয়া, নগদ টাকা দেওয়া, এমন কি বাড়ি-গাড়ি করে দেওয়ারও খবর পাওয়া যায়। এতে করে যেটা হয় তা হচ্ছে ডাক্তার নিম্নমানের ওষুধ রোগীদেরকে লিখে দেয়। কারণ সেই কোম্পানির কাছ থেকে সে ঘুষ নিয়েছে। আবার যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই সেটাও লিখে দেয়। এতে রোগীরা আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবার নিম্নমানের ওষুধে তাদের রোগ ভালো হচ্ছে না।

কোনো নীতিমালা না থাকায় এমন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দাবি বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কেনান বলেন, ‘হঠাৎ করে চিকিৎসকের চেম্বারে কেউ এমন ঢুকে পড়লে এবং সেটা আমাদের নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

ডাক্তারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে ওষুধ বিক্রি বাড়াতে কোম্পানির পক্ষ থেকে দেয়া হয় উপহারের পাশাপাশি নানা অফার। প্রয়োজনের বাড়তিটুকু আবার বিক্রি হয় শহরের বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকার মার্কেটগুলোতে।

ডাক্তারের উপঢৌকনের নানা সামগ্রী- ডায়েরি, তৈজসপত্র, চকলেট মিললো রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের দোকানে। রয়েছে কোম্পানি থেকে দেয়া এসি, ফ্রিজ বিক্রির অফারও। সূত্র বলছে, এসব পণ্য বিক্রির ৬০ শতাংশ টাকা পান ডাক্তার আর ২০ শতাংশ করে পান ম্যানেজার ও বিক্রয় প্রতিনিধি।

এসব বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, তাদের নম্বর ডাক্তারদের কাছে থাকে। ডাক্তাররাই কল দিয়ে বলেন, অনেক কিছু জমে গেছে, এসে নিয়ে যাও।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ বিক্রি বাড়াতে এমন অনৈতিক চর্চায় ৩০-৪০ শতাংশ বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, ‘ফার্মেসি থেকে প্রোভাইডার পর্যন্ত যে অশুভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, এটার প্রভাব কিন্তু আমার দেশের দরিদ্র মানুষের ওপর পড়েছে। তাদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।’

ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির দাবি, প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলাসহ অনৈতিক চর্চার অভিযোগ পেলে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সদস্য কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সমিতির নেতারা কিন্তু এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে। ছবি তোলার প্রয়োজন নেই, যার মাধ্যমে রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য অন্য কারো কাছে চলে যাবে, এমনটা আমরা করব না।’

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের চেয়ার‌ম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, চিকিৎসকের কাছে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সরাসরি যেতে পারবে না; এমন সুপারিশসহ নীতিমালা জমা দেয়া হয়েছে।

এই নীতি মালায় আরও আছে কোম্পানির উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ করা, মেডিকেল কনফারেন্সে আয়-ব্যয়ের হিসাব বাধ্যতামূলকসহ নানা সুপারিশ, যা বাস্তবায়ন হলে সুশাসন ফিরে আসবে এই খাতে।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

অপরাধ নিয়ে আরও পড়ুন

২০২৪ সালের বাঘ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি। এর আগে ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি এবং ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪টিতে। এবারের জরিপে আগের বছরের চেয়ে ১১টি বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।

৫ মিনিট আগে

২০২৩ সালের আগষ্ট মাসের ২৩ তারিখ যোশর ইউনিয়নের মুরগিবের এলাকায় ৪ বছরের কন্যা শিশুকে প্রতিবেশী মোজাম্মেল মোল্লার ছেলে রিফাত মোল্লা মজা কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে বসতঘরের ভিতরে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়

২০ মিনিট আগে

খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলের উপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিমি বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা-ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে

১ ঘণ্টা আগে

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ১ হাজার বিঘা মৎস্য ঘের জমি মালিকদের বকেয়া লিজের (হারি’র) টাকা পরিশোধ না করে ভূমিদস্যু জনৈক সাইদুর রহমান কর্তৃক সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শনের প্রতিবাদে ও মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা থেকে পরিত্রাণের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

১৩ ঘণ্টা আগে