ইজারার নামে নদী গিলে খাচ্ছে খননযন্ত্র

শেষ সম্বলটুকুও নদীতে, তবু চলছে বালু লুট

প্রতিনিধি
মানিকগঞ্জ
Thumbnail image
ছবি: প্রতিনিধি

মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর তীরে চোখের সামনে ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, অথচ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কিছুই করার নেই।

হরিরামপুরের ধুলশুরা গ্রামের আনোয়ারা বেগমের বয়স সত্তরের বেশি। স্বামী সামাদ তালুকদার মারা গেছেন আড়াই বছর আগে। একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তার সংসার। একসময় বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক থাকলেও পদ্মার ভাঙনে ছয়বার বসতভিটা হারিয়ে তরা এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি।

সেখানে ১৪ শতক জমি কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র এক শতাংশ। কালীগঙ্গার ভাঙনে সেই ভিটেটুকুও যে কোনো সময় নদীর পেটে চলে যেতে পারে। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর ধারে বসে আনোয়ারা বেগম খননযন্ত্রে বালু তোলা দেখছেন অপলক দৃষ্টিতে। চোখে জল, কণ্ঠে হাহাকার—“শেষ সম্বলটুকুও কি আর থাকবে না?”

তরা ব্রিজ থেকে সোহাগ টিম্বার হয়ে রমজান আলী হাই স্কুল পর্যন্ত ৫০–৬০টি বাড়ি রয়েছে ভাঙনের হুমকিতে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। রান্নাঘর, টয়লেট নদীতে চলে গেছে, টিকে আছে শুধু শোবার ঘর।

৮০ বছর বয়সী হামেলা বেগমের ১১ শতাংশ জমি থেকে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র দুই শতাংশ। লালু বিশ্বাস ও কাইয়ুম মৃধার ৩২ শতাংশ জমি থেকে কেবল শোবার ঘরটুকুই বেঁচে আছে। নুরুল ইসলামের ২২ শতাংশ জমির মধ্যে আছে মাত্র তিন শতাংশ।

রমজান আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও মসজিদও ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নৃত্যানন্দ বসাক বলেন, “স্কুলের সীমানার খুব কাছাকাছি বালু তোলা হচ্ছে। ভাঙনের ঝুঁকির পাশাপাশি ড্রেজারের শব্দে পড়াশোনায়ও ব্যাঘাত ঘটছে।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফ হোসেন বলেন, বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হবে। এমনকি বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হবে।

তিনি বলেন, এভাবে বালু উত্তোলন করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। কাজেই বিদ্যালয় রক্ষা করতে হলে অবাধে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কালীগঙ্গার তরা ব্রিজ ও জনবসতির মাত্র একশো মিটারের মধ্যে আটটি ভারী খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে বাড়িঘর যেমন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের তরা সেতু।

মানিকগঞ্জে মোট সাতটি বালু মহাল রয়েছে। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দেয়ার মাধ্যমে ৮ মে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঘিওরের তরা বালু মহালটি ৭ কোটি ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকায় ইজারা পান মেসার্স রিজু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কামাল হোসেন।

বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী— বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্রিজ বা সেতুর এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। নদীর তীর থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার বসানো যাবে না। একই সঙ্গে একাধিক খননযন্ত্র দিয়ে উত্তোলন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঙ্গা নদীটি সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী এলাকার ধলেশ্বরী নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে সদর ও ঘিওর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শিবালয়ের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। ৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটির প্রস্থ ২৪২ মিটার।

নদীটির আশেপাশে ঘন জনবসতি, বিদ্যালয়, সেতু ও বাঁধ রয়েছে। তাই আইন অনুযায়ী এই নদীর মূল প্রবাহে (বিশেষত জনবসতির কাছাকাছি অংশে) বালুমহাল ইজারা দেওয়া যাবে না।

কালীগঙ্গা নদীর প্রস্থ যেহেতু ২৪২ মিটার, এবং আইন অনুযায়ী নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। সুতরাং বালু মহাল ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এমনকি ইজারাদার কিংবা প্রশাসন আইনের এসব শর্ত আমলেই নিচ্ছেন না।

মেসার্স রিজু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের যে সীমানা নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছে, আমরা সেখান থেকে বালু উত্তোলন করছি। সীমানার বাইরে থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “বালু মহালের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। নিয়ম অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তিনি আরও জানান, ইউএনও নিয়মিত বালু মহাল পরিদর্শন করছেন। আটটি খননযন্ত্র একসঙ্গে চালানোরও সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জেলা নিয়ে আরও পড়ুন

চন্দনবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান তইবুর রহমান ২০২৫-২৬ অর্থবছরে উপকারভোগীদের মধ্যে ভালনারেবল উইম্যান বেনিফিট ভিডাব্লিউবি কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম, জালিয়াত ও দুর্নীতি করেছেন। সচ্ছল ও অনেক সম্পদশালী ব্যক্তিরা কার্ড পেয়েছেন। প্রতিকার্ডে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন তিনি

২ মিনিট আগে

এই প্রকল্পের লক্ষ্য- দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীদের ই-লার্নিং ও আধুনিক শিক্ষার সুযোগ দেওয়া। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার মানে সমতা আনা এবং শিক্ষার্থীদের শহরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাসে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হবে

৮ মিনিট আগে

যারা এবার সুযোগ পাননি, তারা যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেন। চূড়ান্তভাবে ২৮ জন নির্বাচিত হয়েছেন এবং অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে আরও ৬ জনকে

২৩ মিনিট আগে

বীজ ও সার বিতরণ অনুষ্ঠানে খরিপ-২/ ২০২৪-২৫ মৌসুমে মাসকলাইয়ের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক কৃষককে ৫ কেজি মাষকলাই বীজ, ১০ কেজি ডিএপি এবং ৫ কেজি করে এমওপি সার দেয়া হয়

১ ঘণ্টা আগে