এক স্বপ্নবান বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ‘জ্ঞানর বারেং’ পাঠাগার

একটি প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদের আলোর খোঁজ

প্রতিনিধি
রাঙামাটি
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ৩৫
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অগম্য পথ পেরিয়ে, সবুজ ঘেরা পাহাড় ও ছড়ার কোলে জারুলছড়ি নামক একটি ছোট্ট গ্রামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এক অনন্য পাঠাগার ’জ্ঞানর বারেং'। যার বাংলা মানে, ‘জ্ঞান বৃক্ষ’ বা ‘জ্ঞানতরু’। এটি শুধুই একটি পাঠাগার নয়, এ যেন এক প্রজ্ঞা বিস্তারী আশ্রম, যেখানে অন্ধতা নয়, বরং যুক্তি, ভাষা, ন্যায্যতা ও মানবিকতা চর্চা হয়।

এই পাঠাগারটি বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩৫ নং বঙ্গলতুলি ইউনিয়নের জারুলছড়ি গ্রামে অবস্থিত। এর পেছনে যিনি মূল প্রাণপুরুষ, তিনি হলেন ‘রত্নবোধি ভিক্ষু' (Ratna Bodhi) জারুলছড়ি বন বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ। তিনি শুধুমাত্র এক ভিক্ষু নন, তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বপ্নবান মানুষ, যিনি নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নিরবধি।

সূচনার গল্প: একান্ত শখ থেকে সামাজিক স্বপ্নে-

প্রবজ্জ্যা গ্রহণের বহু আগেই বইয়ের প্রতি প্রবল টান ছিল রত্নবোধি ভিক্ষুর। কিন্তু আর্থিক দীনতার কারণে সে শখ পূরণ হয়নি। সেই অতৃপ্তি থেকে জন্ম নেয় বৃহত্তর এক তৃষ্ণা—নিজে না পারলেও, যেন অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বইয়ের আলোয় বড় হতে পারে।

২১ সালের অনেক আগে থেকেই তাঁর মনে ‘পাঠাগার’ গড়ার চিন্তা ছিল। তবে সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিবেশে তা বাস্তবায়িত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের শেষের দিকে স্থানীয়দের সহানুভূতি ও নিজস্ব প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন ‘জ্ঞানর বারেং’ পাঠাগার।

পাঠাগারের কার্যক্রম ও পরিসর-

বর্তমানে পাঠাগারটির নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ জন, যদিও মাঝে মাঝে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।পাঠাগারে প্রতি সপ্তাহে একদিন নিয়মিত পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা শেখানো হয়, এবং ইতিমধ্যে ৫টি কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।স্থানীয় কিশোর-কিশোরীদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশেও পাঠাগারটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তবে এই মহৎ উদ্যোগটির এখনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই এবং পাঠাগারের নিজস্ব কোনো ভবনও নেই। একটি বাঁশ ও টিনের ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা চললেও অর্থের অভাবে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ বাজেটে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

মানবিক উদ্যোগ: ‘স্বপ্নতরী ফান্ড’--

শুধু বই পড়া বা ভাষা শেখানো নয়, রত্নবোধি ভিক্ষু আরও বড় কিছু চিন্তা করেন। তিনি চান কোনো শিক্ষার্থী আর্থিক দুরবস্থার কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ুক। সেই ভাবনা থেকেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘স্বপ্নতরী ফান্ড’, যা পাঠাগার ভিত্তিক একটি দাতব্য ফান্ড।

এই ফান্ডের বর্তমানে চারজন নিয়মিত দাতা সদস্য রয়েছেন। তবে, কেউ চাইলে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অনুদান দিতে পারেন এবং মাসিক দাতা সদস্য হিসেবেও যুক্ত হতে পারেন।

একটি মানবিক স্বপ্ন: জ্ঞান, যুক্তি ও ন্যায়ের সমাজ-

রত্নবোধি ভিক্ষুর স্বপ্ন বুদ্ধের শুদ্ধ ও মানবিক শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করা। তিনি বিশ্বাস করেন শিক্ষাই পারে একটি নতুন, ন্যায়ের ভিত্তিতে গঠিত সমাজ গড়ে তুলতে।তিনি চান পাঠাগারের শিশুরা যেন কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী ও মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, যেন তারা মুক্তচিন্তায় সমৃদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।

পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা এখনও সীমিত। তাই যেকেউ যদি বই দান করতে চান, ভান্ত তা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করবেন। এছাড়া ‘স্বপ্নতরী ফান্ড’-এ অর্থ সহায়তা করতেও আপনি স্বাগত। আপনি চাইলে নিয়মিত মাসিক দাতা সদস্য হিসেবেও নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।

একটি পাঠাগার শুধুই বইয়ের ঘর নয়, এটি ভবিষ্যৎ নির্মাণের কেন্দ্র। আর ‘জ্ঞানর বারেং’ পাঠাগার ঠিক তেমনই এক স্বপ্নযাত্রার নাম, যার কাণ্ডারি এক নিরহংকার বৌদ্ধ ভিক্ষু রত্নবোধি।

তাঁর মতো মানুষের স্বপ্ন যেন অঙ্কুরেই ঝরে না যায়—এটিই হোক আমাদের সকলের প্রার্থনা ও প্রচেষ্টা।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জেলা নিয়ে আরও পড়ুন

ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সেপ্টেম্বর বিকেলে জেলার প্রতিটি উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল, ৮ সেপ্টেম্বর হরতাল-অবরোধ ও নির্বাচন কমিশন কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান,৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ মিছিল, ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর টানা হরতাল

১৫ ঘণ্টা আগে

বরাদ্দ পাওয়া প্রতিটি এতিমের বিপরীতে আরও দ্বিগুণ সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকার কথা। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিবন্ধিত ৫০ জনের বেশি থাকার কথা থাকলেও নিয়মিত বসবাস করে মাত্র ৮ থেকে ১০ জন শিশু

১৫ ঘণ্টা আগে

বাগেরহাট পল্লি বিদ্যুতের কয়েকজন কর্মচারী জানান, কর্মচারীরা চার দফা দাবি নিয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন। এর মধ্যে রয়েছে—আরইবি ও পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির একীভূতকরণ বা অন্য বিতরণ সংস্থার মতো কোম্পানি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি, সব চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ী করা, চাকরিচ্যুত ও বরখাস্তদের পুনর্বহাল

১৫ ঘণ্টা আগে

সম্প্রতি প্রকাশিত গেজেটে ৯নং ওয়ার্ডকে রংপুর-১ আসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা স্থানীয় বাসিন্দারা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য দাবি করে এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন

১৬ ঘণ্টা আগে