খুলনায় লাশের সারি বিধ্বস্ত জননিরাপত্তা

প্রতিনিধি
খুলনা
Thumbnail image
ছবি: প্রতিনিধি

খুলনা আজ যেন এক আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এক সময় শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত শহরটি এখন সন্ত্রাস ও হত্যার হানাহানির কবলে। নদী, রাস্তাঘাট, গ্রাম ও উপকূল—সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। নদীতে লাশ, রাস্তায় হঠাৎ গুলির শব্দ, রাতের আঁধারে অস্ত্রধারীদের মহড়া—এবং প্রতিদিনের সংবাদে নতুন হত্যাকাণ্ডের খবর। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে একদিনে চারটি হত্যাকাণ্ড, আদালতের সামনে দিনদুপুরে হত্যাযজ্ঞ, পাড়া-মহল্লায় গুলির শব্দ—এখন খুলনার সাধারণ মানুষের জন্য রাত এবং দিন উভয়ই আতঙ্কের।

খুলনা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর থেকে নগরীতে ৫০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, জেলার অন্যান্য এলাকায় আরও ৪৫টির বেশি। নদী–নালায় এক বছরে ৫০টি লাশ উদ্ধার হয়েছে, যাদের অনেকের পরিচয়ই জানা যায়নি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৩০টি গুলি বা কুপিয়ে হত্যা। রূপসা উপজেলায় দুই মাসে পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামিনে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা এলাকা দখলের লড়াই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে অপরাধ বাড়াচ্ছে।

নৌপুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নদী থেকে উদ্ধার হওয়া ৫০টি লাশের মধ্যে পুরুষ, নারী ও শিশু রয়েছে। কিশোর গ্যাং, লুট হওয়া অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার—সব মিলিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আরও জোরদার হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবার ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা, রাষ্ট্রীয় নজরদারির অভাব এই সহিংসতার পালে হাওয়া জুগিয়েছে।

নগরীর রাতগুলো এখন অনেক পাড়া-মহল্লায় রণক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে। মোটরসাইকেলে টহল দেয়া অস্ত্রধারীরা আকাশে গুলি ছুঁড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। শহরের মানুষদের নিরাপত্তাহীনতার প্রতিদিনের বাস্তবতা— ‘যে মারা গেছে, সে মুক্ত, যারা বেঁচে আছে, তারা বন্দি।’ নিহতদের পরিবারগুলো ভয়, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ভেঙে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সীমাবদ্ধ। অনেকেই অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ পরে আসে এবং তদন্ত নিয়মিত ব্যাহত হয়। মূল হোতারা ধরা পড়লেও অধিকাংশই ‘ভাড়াটে হাত’ বা নীচু স্তরের অপরাধী। জামিন পেলে তারা আবার একইভাবে কাজে ফিরে আসে। পুলিশ জানাচ্ছে, বড় ধরনের অস্ত্র লুট হয়েছে, প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী সক্রিয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীদের দাপট বেড়েছে।

নাগরিক সমাজের উদ্বেগ ও ক্ষোভও রয়েছে। সমাজের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক সমর্থন ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী অপরাধীদের শক্তি বাড়াচ্ছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আইনজীবী বাবুল হাওলাদার বলছেন,

“খুলনা শহর অনিরাপদ। সন্ত্রাসীরা যখন খুশি খুন করে নির্বিঘ্নে চলে যায়, সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করছে।”

খুলনার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতারও সতর্ক সংকেত। অবাধ অস্ত্র, চরমপন্থি সংগঠনের পুনরুত্থান, সমাজের নৈতিক কাঠামোর ক্ষয়, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নামে সন্ত্রাস—সব মিলিয়ে শহরকে অস্থিরতার গভীর খাদে ঠেলে দিচ্ছে। খুলনা আজ দাঁড়িয়ে আছে এক অচিহ্নিত সন্ধিক্ষণে, যেখানে প্রতিটি রাতই প্রশ্ন ফেলে, আগামীকাল আবার কে?

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জেলা নিয়ে আরও পড়ুন

খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম স্মারকগ্রন্থ ‘উজ্জীবন’ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে খাগড়াছড়ি অফিসার্স ক্লাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ। তিনি প্রকাশনাটি প্

১ দিন আগে

মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মি কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৯ বাংলাদেশি জেলে অপহরণ করেছে। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) শাহপরীর দ্বীপের নিকটস্থ নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মাছ শিকারের পর ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে।

১ দিন আগে

রাজশাহীতে ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত লং মার্চ ও ঘেরাও কর্মসূচি পুলিশের কঠোর ব্যারিকেডের কারণে সফল হয়নি। ‘জুলাই ৩৬ মঞ্চ’ আহ্বানিত এই কর্মসূচি ভদ্রা মোড় থেকে শুরু হলেও হাই কমিশন কার্যালয়ের প্রায় ১০০ মিটার আগে পুলিশ বাধা দিয়ে মিছিল আটকে দেয়।

১ দিন আগে

নীলফামারীতে অনুমতি ছাড়া মাটি ব্যবহার ও পরিবেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনটি ইটভাটায় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

১ দিন আগে