নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় জাতি

প্রতিনিধি
নিজস্ব প্রতিবেদক
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে দেশবাসী। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা মহলসহ সর্বস্তরের মানুষ আছে একটি রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায়। চলমান অস্থিরতার মধ্যে চরম আস্থাহীনতায় এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে দেশের মানুষ । আকাশচুম্বী আশা নিয়ে ১৮ কোটি মানুষ ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ওপর যে পরিমাণ আশা-প্রত্যাশা করেছিল, তার কতটুকু পেয়েছে সে হিসাব মানুষ করা শুরু করেছে। যদিও এই সরকারের মূল কাজ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সরকার ঘোষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাকি আরও কমপক্ষে ৪ মাস। রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ভাগে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছে তেমনি সাধারণ মানুষও অনেক দিন পর একটা সত্যিকারের নির্বাচনে নিজেদের ভোট দিয়ে পছন্দমতো সরকার গঠন করার অপেক্ষায় আছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সাফ বলে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তারা ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের পরবর্তী ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করবে না। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এক কণ্ঠে বলছেন, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।’ ফলে অর্থনীতি এখন এক ধরনের ‘অপেক্ষার ঘূর্ণিতে’ পড়েছে। ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা সবাই রাজনৈতিক ম্যান্ডেট ও নীতিগত স্থিতিশীলতার প্রত্যাশায় আছেন।

অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার না থাকায় আইএমএফের কিস্তি ঝুলে গেছে। বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষায় আর অর্থনীতিও স্থবির। আস্থা ফিরলেই ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজি, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি— এমনটাই তাদের অভিমত। বলেন, ‘অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক আস্থার ওপর। সেই আস্থা পুনর্গঠনের দায়িত্ব সরকারেরই।’

আইএমএফের শর্তে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অগ্রাধিকার : ২০২২ সালে আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাঁচ কিস্তি ছাড় হলেও ষষ্ঠ কিস্তি এখন ঝুলে আছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, নতুন সরকার গঠনের পরই তারা বাকি অর্থছাড়ের সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি রাজনৈতিক আস্থা ও নীতির ধারাবাহিকতার প্রশ্ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২২ শতাংশ কমেছে। নতুন প্রকল্প নিবন্ধনেও গতি নেই। বিডা কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন ‘অপেক্ষা-পর্বে’ আছেন। অনেকে নতুন কারখানা না করে পুরনো ব্যবসা সংকুচিত করছেন। কেউ কেউ বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করছেন, যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক ইঙ্গিত।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই স্থবিরতা কেবল রাজনৈতিক নয়; সরকারের প্রস্তুতি ও নীতি পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাবও দায়ী। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বলেন, ‘সরকার যদি অর্থনৈতিক নীতিতে পূর্বানুমানযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব এত গভীর হতো না।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন সরকার গঠনের পর ঋণচুক্তি দ্রুত সচল হবে।

বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে ঋণ চাহিদা কমেছে, নির্মাণসামগ্রী, ইলেকট্রনিকস ও রিয়েল এস্টেট খাতে নতুন প্রকল্প স্থগিত রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, এ কারণে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, বাজারে চাহিদা নেই, বিনিয়োগে আগ্রহ নেই। অর্থনীতি এখন নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না।

এদিকে জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, কেউ বলছে ফেব্রুয়ারিতে আবার কেউ বলছে নাও হতে পারে। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

তার ওপর ব্যবসার খরচ বাড়ছে, জ্বালানি নিরাপত্তা দুর্বল, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি। ফলে ব্যাবসায়িক পরিবেশটা অস্থির। যতক্ষণ না রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকার আসে, ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইবেন না।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলেই অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরে আসবে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, নির্বাচিত সরকার গঠনের পর আইএমএফের ঋণচুক্তি পুনরায় সচল হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। তাঁর মতে, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে আস্থা পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক নীতিতে স্বচ্ছতা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং আইনের শাসন ও পূর্বানুমানযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করা।

২০২৫ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ, যা ইতিহাসের অন্যতম সর্বনিম্ন হার। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন, কারণ সুদের হার বেশি, ব্যাংকগুলো সতর্কভাবে ঋণ দিচ্ছে আর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১৬.৫৯ শতাংশ। কারণ সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থের জোগান কমে যাচ্ছে। ফলে শিল্প ও ব্যবসা সম্প্রসারণ শ্লথ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নীতি মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমালেও তা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট জনেরা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতির অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ, বিনিময় হার ও ব্যাংক খাতে ছিল অস্থিরতা। তবে সরকার দ্রুত কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন—ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে রিজার্ভ বেড়েছে, বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতি। তিন বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধারের পথে থাকলেও টেকসই স্থিতিশীলতার জন্য আরো কার্যকর নীতি দরকার।

হাসিনাসহ মাফিয়াতন্ত্রের অনেকের বিচার অনেক দূর এগিয়েছে। আগামী ৪ মাসে ২/১টা রায় হতেও পারে। বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের। বৈষম্যমুক্তির স্বপ্নে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু গত এক বছরে সেই স্বপ্ন অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। আশাহত আর হতাশার বেদনায় আক্রান্ত মানুষ আজ। এর জন্য অনেকাংশে পাশের দেশ দায়ী।

রাজনৈতিকভাবে পুরো একটা ভঙ্গুর দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সবরকম ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাজনৈতিক হানাহানি এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের মতো দেশের চরম বৈরিতা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং ছাত্রদের একক কর্তৃত্বমূলক আচরণ, বিএনপির কতিপয় নেতার আস্ফালন এবং জামায়াতের নির্বাচন বর্জনের হুমকি তাকে কিছুটা ঝামেলায় ফেলেছিল। তা ছাড়া সরকারের ভিতরে ও বাইরে কতিপয় কুচক্রী নির্বাচন-বিরোধী তৎপরতার কারণে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল।

এদিকে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা কাজ করছে না মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জুলাই আন্দোলনকে সফল করতে হলে জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার আসতে হবে। দেশের বিনিয়োগকারীরা নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা করছে।

আমীর খসরু বলেন, জুলাই আন্দোলন নিয়ে বিভাজন হচ্ছে। তবে আন্দোলন হাইজ্যাক করার সুযোগ নেই। যাদের নির্বাচন ভীতি রয়েছে, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘যারা নির্বাচনকে ভয় পায়, তাদের রাজনীতির দরকার নেই। তারা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করুক। এনজিও হিসেবে কাজ করতে পারে। আপনি রাজনীতিও করবেন, আবার নির্বাচনেও যাবেন না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবেন, এটা তো হতে পারে না।’

আমীর খসরু বলেন, বিশ্বের যেসব দেশ বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে, তারা যত তাড়াতাড়ি নির্বাচিত সরকার গঠন করেছে, তত তাড়াতাড়ি দেশের উন্নতি হয়েছে। আর যেসব দেশে নির্বাচিত সরকার আসতে দেরি করেছে তারা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে পরিচিতি পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিভেদ না থাকলে তো রাজনীতি চলবে না। আমরা শেখ হাসিনার বাপের মতো বাকশাল করতে বসিনি। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষের চিন্তাভাবনরা যে পরিবর্তন হয়েছে, এই পরিবর্তন মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক দলের কাজ করতে হবে। দেশে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

দেশব্যাপী নিয়ে আরও পড়ুন

আদালত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ৪৬৯.৪৮ একর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন; জমিগুলো গাজীপুর ও কক্সবাজারের ৬ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত।

২ দিন আগে

রপ্তানি করা পণ্যের বিপরীতে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসছে না। একটি অসাধু চক্রের কারণে গার্মেন্টস খাতের রপ্তানির ৩০ হাজার চালানের বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেশে আসেনি।

২ দিন আগে

বাংলাদেশে ৭ম জাতীয় পে-স্কেল ১ জুলাই ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে মূল বেতনে প্রায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে ৮ম পে-স্কেল ১ জুলাই ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হয়

২ দিন আগে

রোববার (২৬ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর জানায় যে, কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ‘সন্ধ্যা ৬টার পর বেনাপোলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়

৩ দিন আগে