পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে দাপট দেখানো সন্ত্রাসী চক্রগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’-এ ৫৮ জনকে গ্রেফতারের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে আলোচিত ‘কাকন বাহিনী’। চরের বালু লুট, ফসল দখল, চাঁদাবাজি এবং কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

অভিযানের পরদিনই বাহিনীর প্রধান দাবি করা হাসানউজ্জামান কাকন ওরফে ইঞ্জিনিয়ার কাকন নাটকীয়ভাবে প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রায় ৩৪ মিনিটের ফোনালাপে তিনি নিজেকে নির্দোষ, বৈধ ব্যবসায়ী ও ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দাবি করেন। কাকন জানান, তিনি প্রকৌশলী এবং দীর্ঘদিন বিদেশে চাকরি করেছেন। ২০২০ সাল থেকে নাটোরের লালপুরের দেয়াড় বাহাদুরপুর বালুমহাল ইজারা নিয়ে বৈধভাবে ব্যাবসা করছেন। ইজারার মূল্য ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং তিনি সেখানে একজন অংশীদার।

তার দাবি, ‘কাকন বাহিনী’ বলতে যা প্রচার হচ্ছে তা দুর্বৃত্তদের বানানো নাটক। ২৭ অক্টোবর তিন কৃষক হত্যার ঘটনায় তার নামে মামলা হলেও সেটিকেও তিনি সাজানো বলে অভিহিত করেন। তার ভাষ্য, ছয়টি মামলার কোনোটির সঙ্গেই তিনি জড়িত নন। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শহিদুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে স্পিডবোটে থাকা ছবিটি তিনি স্বীকার করলেও বলেন, সেটি নৌকাবাইচ দেখতে যাওয়ার সময়ের। বরং তিনি অভিযোগ করেন, স্পিডবোট ছিনতাইয়ের ঘটনার পেছনে পাবনার এক ড্রাইভার সন্ত্রাসী ভাড়া করে তাদের ওপর গুলি চালায়। কাকনের দাবি, তিনি বা তার লোক কখনো কারও কাছ থেকে চাঁদা নেয়নি, কাউকে আঘাত করেনি— সবই সাজানো নাটক।

তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের তথ্য বলছে ভিন্ন চিত্র। কাকন বাহিনীর ভয়ে কেউ ইজারায় নামতে সাহস পায় না বলেই অভিযোগ। ফলে প্রতি বছর একই চক্র ইজারা পায় এবং বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সশস্ত্র আধিপত্য। কাকন নিজে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে লোকসানের কথা বললেও প্রশ্ন উঠছে— তার বাহিনী সক্রিয় থাকলে এই অবৈধ উত্তোলন করছে কারা?

প্রশাসনের হাতে থাকা ড্রোন ভিডিওতে দেখা যায়, কাকন বাহিনী নিয়মিত স্পিডবোটে সশস্ত্র মহড়া দিত এবং রাজশাহী, পাবনা, নাটোর ও কুষ্টিয়ার চরাঞ্চলে তাদের দাপট ছড়ানো ছিল। ২৭ অক্টোবর ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে তিন কৃষক হত্যার ঘটনায় কাকন প্রধান আসামি। পুলিশ নিশ্চিত করেছে— কথায় কথায় গুলি ছোড়া, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও হত্যা— এসব অভিযোগ বহুদিন ধরেই কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল।

মামলার এজাহারে কাকনের নাম এসেছে তিনভাবে— হাসানউজ্জামান কাকন, মো. রোকনুজ্জামান কাকন ও ইঞ্জিনিয়ার কাকন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, একাধিক নাম ব্যবহার পরিচয় গোপন বা আইনি জটিলতা তৈরির কৌশল হতে পারে।

অভিযান চক্রগুলোকে শক্ত বার্তা দিলেও কাকনের আকস্মিক ফোনকল এবং নিজেকে প্রকৌশলী পরিচয়ে ‘নির্দোষ’ প্রমাণের চেষ্টা নতুন প্রশ্ন তুলেছে— এটি কি বাস্তবিকই নির্দোষের আর্তি, নাকি অপরাধ আড়াল করার কৌশল?

চরের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা— দ্রুত, স্বচ্ছ ও ফরেনসিক তদন্ত; অবৈধ বালু বাণিজ্যের দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা; সশস্ত্র আধিপত্যের অবসান এবং স্থায়ী নিরাপত্তার পরিবেশ। ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’ শুধু গ্রেপ্তার অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না— চরের মানুষ, ফসল ও বালুসংস্থান বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি ও টেকসই ব্যবস্থা এখন জরুরি।