দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রপথে বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু মোংলা বন্দরের চেহারা পাল্টে যেতে পারে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরটিকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর বানিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। এখনো চূড়ান্ত কোনো চুক্তি না হলেও সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের খসড়া পরিকল্পনায় নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা দিতে চায় বলে আলোচনায় এসেছে। তবে এখনও তা প্রস্তাব ও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, চীনের প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যার একটি বড় অংশ মোংলা ও চট্টগ্রামের সম্ভাব্য শিল্পাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হতে পারে। এই বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে মোংলায় একটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।

চীনের প্রস্তাবিত সহায়তার মধ্যে রয়েছে বন্দরের ড্রেজিং, আধুনিক টার্মিনাল নির্মাণ, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম সংযোজন এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশ নির্মাণ। বিশেষভাবে ৩৩৫.৭৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র বন্দর আধুনিকায়নের জন্য, যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইনারবার ড্রেজিং, বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও আধুনিক কাস্টমস ব্যবস্থার অটোমেশন। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায়ও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, “চীন অর্থায়নে বন্দরের জন্য একটি আধুনিকায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার আওতায় থাকবে অত্যাধুনিক কনটেইনার ইয়ার্ড, কনটেইনার জেটি ও প্রায় ৪১টি সরঞ্জাম। এগুলো ম্যানুয়াল ও অটোমেটেড- দুই মোডেই কাজ করতে পারবে। এটি সম্পন্ন হলে মোংলা হবে দেশের প্রথম অটোমেটেড সমুদ্রবন্দর।”

বর্তমানে মোংলা বন্দর বছরে প্রায় ৮০০-১০০০টি জাহাজ, ১ লক্ষ TEU কন্টেইনার এবং প্রায় ১.২ কোটি মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডল করে। প্রস্তাবিত উন্নয়ন ও চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে এই সক্ষমতা তিনগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। বিশেষ করে ৯ মিটার পর্যন্ত ড্রাফট গভীরতা বাড়ানো গেলে বড় আকারের জাহাজ পরিচালনা সম্ভব হবে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বন্দরের গুরুত্ব বাড়াবে।

বাগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, “চীনের বিনিয়োগে যদি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা হবে মোংলা বন্দরের জন্য একটি মাইলফলক। বন্দর ব্যবহারকারীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যাবে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়িত হলে ওই অঞ্চলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, তৈরি হবে বিপুল কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক রপ্তানি আয়ও বাড়বে। তবে এই বিনিয়োগে স্বচ্ছতা, পরিবেশ রক্ষা ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।