বিতর্কিত ইকবালকে পর্ষদে রেখেই এনআরবি ব্যাংকের সংস্কার !

প্রতিনিধি
স্টাফ রিপোর্টার
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১১: ১৯
Thumbnail image

বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদে রেখে এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে দুর্নীতিবাজদের বাদ দিয়ে পর্ষদ পুণর্গঠন করা না হলে ব্যাংকটি আবারও রুগ্ন হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের অভিযোগ,পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার এবং পাচারকৃত অর্থে যুক্তরাজ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার দায়ে অভিযুক্ত ইকবাল আহমেদ ওবিকে পরিচালক করে ব্যাংকটির পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। বিতর্কিত এই ব্যবসায়ী ফ্যাসিস্ট হাসিনা-রেহানার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত। স্বৈরাচারের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে তোলেন এনআরবি ব্যাংক। নিজের দুর্নীতির হাতিয়ার বানিয়ে ব্যাংকটি তিনি ধ্বংস করেছেন বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্নীতির দায়ে ২০১৫ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি।

d04465a82401b769b6c70f73dc71c4a2504c935497062cd5

জানা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পর্ষদ গঠনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালক করা হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিইকে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শেখ মো. সেলিম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক এমডি কামরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি শেখ মতিউর রহমান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরীফ নুরুল আহকাম ও হিসাববিদ মিজানুর রহমানকে।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতো জুলাই বিপ্লবে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে ফের এই ইকবালদের মাধ্যমে লুটপাট হোক, তা চাইছেন না ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটের সহযোগী, হিমায়িত মাছ ব্যবসার আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ইকবালকে কেন ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসানো হলো? তার ক্ষমতার উৎস কী? তাদের দাবি, অতি দ্রুত ইকবাল আহমেদ এবং তাঁর দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদের সম্পদের উৎস খুঁজে বের করে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হোক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদ আপন তিন ভাই। তারা তিনজনই এনআরবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। ১৭ মার্চ ২০২৫ শেষে তারা যথাক্রমে ৩.৮০ শতাংশ, ১.৫১ শতাংশ ও ২.১৩ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার। এ ছাড়া সিমার্ক (বিডি) লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, আইবিসিও এন্টারপ্রাইজ, আইবিসিও ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ম্যানরু ইন্টারন্যাশনাল ও ম্যানরু শপিং সিটিতেও তাঁদের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যুক্তরাজ্যে একাধিক কম্পানি রয়েছে তাদের। যার মধ্যে রয়েছে সিমার্ক পিএলসি, আইবিসিও হোল্ডিংস, এমএআই ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস, ভার্মিলিয়ন গ্রুপ লিমিটেড, ফ্লাইং ইউনিকর্ন, ওপেনশ হোল্ডিংস লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, ইউকেবিসিসিআই, ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং নিউ ইস্ট ম্যানচেস্টার লিমিটেড। এই কোম্পানিগুলো মূলত রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও এই কোম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া লন্ডন-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সম্পদের মালিকানা গড়ে তুলেছেন তিনি। শুধু লন্ডনেই তাঁর প্রায় দুই ডজন বাড়ি ও অত্যাধুনিক প্রপার্টি রয়েছে।

সূত্র জানায়, বিগত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন ইকবাল। তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলজুড়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে অসংখ্য ছবি শেয়ার করা হতো, যা তাঁকে 'হাসিনা বিশ্বস্ত' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও ৫ আগস্টে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফেসবুক থেকে ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

WhatsApp Image 2025-03-29 at 1.39.54 PM

সূত্র আরও জানায়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শীর্ষ ২০ জন অর্থদাতার মধ্যে ওবিইও একজন। পতিত সরকারের আমলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিমার্ক গ্রুপের আড়ালে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের অর্থপাচারে বাহক হিসেবে কাজ করতেন ইকবাল। সিমার্ক গ্রুপের প্রধান ব্যবসা হলো মাছ রপ্তানি। তবে এর আড়ালে তিনি দেশ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্য ও সোনা চোরাচালান করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ভাড়া চুক্তির অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক থেকে গ্রহণ করায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদকে লিগ্যাল নোটিশ দেয় এনআরবি ব্যাংক। এতে বলা হয়, নোটিশ পাওয়ার পর অতিদ্রুত অতিরিক্ত ভাড়া বাবদ ব্যাংক থেকে নেওয়া চার কোটি ৫১ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়। নোটিশদাতা ব্যারিস্টার হেলাল উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, আইনি নোটিশ দেওয়া হলেও, এখনও পর্যন্ত বিবাদীপক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ক্ষমতার জোরে ইকবাল আহমেদ অনেক অভাবনীয় কাণ্ডও ঘটাতেন বলে জানা গেছে। ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সে অনিয়ম করে তিনি দুই লাখ পাউন্ড গায়েব করেন। এরপর ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের নেতারা ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি মামলায় হেরে যান। দেশটির আদালত ইকবাল আহমেদকে পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেন এবং চেম্বার অব কমার্স থেকে আজীবন বহিষ্কার করেন। এর আগে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির গোপন অর্থদাতা ইকবাল দলটিকে ১২ হাজার পাউন্ড ডোনেশন দেওয়ার পর তা ফেরত চেয়ে বিতর্কিত হন।

ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দাতা তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য পার্টির তহবিল ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর এই আচরণ নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে সমালোচনার ঝড় ওঠে- যেখানে জনগণের করের টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এই ঘটনা ঘিরে দলটির অভ্যন্তরীণ আর্থিক নীতিমালা ও নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। এ প্রেক্ষিতে স্থানীয় গণমাধ্যম ও সুধীসমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে কঠোর নিয়মকানুন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়।

এদিকে ইকবালের অর্থপাচারের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বাংলাদেশকে 'ধূসর তালিকা' থেকে মুক্ত করতে ইকবালের কেলেঙ্কারি দ্রুত বিচারাধীন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থপাচার ও ব্যাংকের অর্থ লুটে কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে পুনরায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চলছে। বিতর্কিত ব্যক্তিকে ব্যাংকের শীর্ষ পদে দিয়ে ব্যাংকটির সংস্কার সম্ভব হবে না।

এ প্রসঙ্গে ইকবাল আহমদ ওবিইর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এনআরবি ব্যাংকের সচিব রেজাউল করিমকে ফোন দেওয়া হলে তিনি জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করতে বলেন। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন মুরাদকে ফোন দেওয়া হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

দুর্নীতি নিয়ে আরও পড়ুন

গ্রেফতারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিলো। তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলমান হত্যা মামলায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে

৬ ঘণ্টা আগে

শনিবার রাতে মদ্যপ অবস্থায় তিনি বাসার গৃহকর্মী ও পরিচর্যাকারীদের হুমকি-ধমকি দেন। রাত ১১টার দিকে এক গৃহকর্মী জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা সামসুদ্দোহাকে মদ্যপ অবস্থায় পান। এ সময় তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন

৬ ঘণ্টা আগে

হোসেন মিয়ার নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষীতা শিশুটির বাবা নুরু মিয়া মামলা দায়ের করেছেন। রোববার দুপুর ১টায় হোসেন মিয়াকে কিশোরগঞ্জ আদালতে পাঠানো হয়েছে

৭ ঘণ্টা আগে

সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামে ফটিকছড়ির নোয়াহাট এলাকায় প্রথম অভিযান পরিচালিত হয়। এসময় একটি বাড়ি তল্লাশি করে ২৫৩০টি ধারালো ছুরি, চাপাতি, কুড়াল ও দা উদ্ধার করা হয়

৯ ঘণ্টা আগে