ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণ মুক্তিপণ দিয়ে ১০৪ দিন পর ফিরলেন দেশে

প্রতিনিধি
মাদারীপুর
Thumbnail image
সব কিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব মো. হাবিবুল্লাহ

ইউরোপে গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে চেয়েছিলেন মো. হাবিবুল্লাহ নামে এক তরুণ। কিন্তু এ দেশ-ও দেশ ঘুরিয়ে দালালরা তাকে নিয়ে যায় লিবিয়ায়। সেখানেও এক দালালের হাত থেকে আরেক দালালের হাতে বদল হতে থাকেন। অবশেষে মুক্তিপণ দিয়ে ১০৪ দিন পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন মাদারীপুরের এ তরুণ।

স্নাতকোত্তর করে কয়েক বছর চাকরির চেষ্টা করেও কিছু না হওয়ায় কুলপদ্দী বাজারে বাবার মুদি দোকানে সময় দিতে শুরু করেন। পড়াশোনা করেও জীবনটা এভাবে আটকে যাবে, মেনে নিতে পারতেন না। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। বড় ছেলে হিসেবে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতেন। তাদের এলাকার অনেকেই বিদেশ থাকে। তিনিও ওয়ার্ক পারমিট জোগাড়ের চেষ্টায় নেমে পড়লেন। কোনোভাবেই যখন পারলেন না, তখন এক মামার মাধ্যমে দালাল বোম্বাই রিপনের (সরদার) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি মরক্কোর ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। সে দেশে কিছুদিন থেকে সুযোগ বুঝে ইউরোপের স্পেন বা ইতালিতে পাড়ি জমাতে পারবেন বলে আশ্বাস দেন।

হাবিবুল্লাহ বলেন, আমার সঙ্গে এলাকার আজাদ হোসেনও যোগ দিল। আমরা দুজন সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। মামার মাধ্যমে আমরা দুজন দালালের সঙ্গে চুক্তি করলাম। ১৭ লাখ টাকায় স্পেন বা ইতালি পৌঁছে দেবে। কথামতো পাসপোর্টসহ যাবতীয় কাগজ তার লোকজনকে দেওয়া হলো। নগদ অর্থ নিল সাড়ে চার লাখ। দিনকয়েক পর আমাদের যাত্রার তারিখ জানানো হলো।

২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর আমাদের যাত্রার দিন। ঢাকায় আমাদের হাতে শ্রীলঙ্কার টিকিট আর কিছু ডলার ধরিয়ে দিয়ে রিপন জানালেন, সব বিমানবন্দরে তার লোকজন আছে। আমাদের কোনো চিন্তা নেই।

ঢাকা থেকে প্রথমে ভারতের চেন্নাইয়ে নিল। সেখানে ১৬ ঘণ্টার ট্রানজিট শেষে পরদিন পৌঁছালাম শ্রীলঙ্কা। একদিন শ্রীলঙ্কায় রাখল। তারপর দুবাই হয়ে গেলাম মিশর। এখান থেকে সরাসরি মরক্কো যাওয়ার কথা। মিশরের বিমানবন্দরে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হলো। ভাবলাম, ভিসা করার জন্য নিয়েছে। সেখানে আমাদের মতো আরও ৪০-৫০ জন বাংলাদেশিকে পেলাম। তাদেরও বিভিন্ন দেশে যাওয়ার কথা। ২৩ ঘণ্টা পর পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বুঝতে পারলাম, প্রতারণার শিকার হয়েছি। কারণ, আমাদের লিবিয়ার ভিসা দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই দেশে আমাদের যাওয়ারই কথা না। দালালদের একজন আমাদের কাছে এসে জানাল, চিন্তার কিছু নেই, আমাদের লিবিয়া থেকে আলজেরিয়া হয়ে মরক্কোয় নেওয়া হবে।

বাধ্য হয়ে লিবিয়ার বিমানে চড়ে বেনগাজিতে গেলাম। সেখানে দালালের স্থানীয় লোকজন ছিল। তাদের সঙ্গে ত্রিপোলি পৌঁছালাম ১৯ অক্টোবর। ততদিনে আমাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন আরও দুজন। তাদের বাড়িও মাদারীপুর। সবাইকে ৫-৬ দিন ত্রিপোলির একটা রুমে রাখল তারা। তারপর একদিন সকালে আমাদের একটা গাড়িতে তোলা হলো। এই গাড়িই আলজেরিয়ার সীমান্তে পৌঁছে দেবে। এক অজানা শঙ্কা নিয়ে চলতে থাকলাম। ৪-৫ ঘণ্টা পর একটা জায়গায় গাড়ি থামল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে যেতেই কিছু পুলিশ এসে আমাদের ধরল। সবার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। কাছাকাছি একটি পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। বুঝতে পারলাম, দালাল চক্র আমাদের পুলিশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এক দিন পর পুলিশের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে মামাকে কল দিলাম। উচ্ছ্বাস নিয়ে তার প্রশ্ন, ‘কেমন আছস, মামা? মরক্কোতে পৌঁছে গেছস?’

রাগে-ক্ষোভে তাকে গালাগাল করতে লাগলাম। বললাম, আমরা পুলিশের কাছে বন্দি। তার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বাড়িতে কল দিয়ে জানলাম, দালাল চক্র জানিয়েছে, আমরা মরক্কো যাচ্ছি, তাই মোবাইল সঙ্গে নেই। চুক্তি অনুযায়ী বাদবাকি টাকাও তারা নিয়ে গেছে।

দালাল চক্রের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানাল, এক হাজার ডলার দিলে পুলিশ ছেড়ে দেবে। দালাল চক্রকে দেওয়া হলো সেই টাকা। পুলিশ এবার আমাদের লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে তুলে দিল। জেলখানার মতো জায়গায় আমাদের রাখা হলো। রুমে রুমে আমাদের মতো ৬০ জনের বেশি মানুষ। সবাই বাংলাদেশি। পাঁচ দিন সেখানেই কেটে গেল। আমাদের মাধ্যমে পরিবারের কাছে জনপ্রতি ৫ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করল তারা। এত টাকা কীভাবে দেবে আমার পরিবার?

আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলো। গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাল এক দিন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাড়িতে পাঠাল। শারীরিকভাবে যত নির্যাতন করা যায়, সবই তারা করতে থাকল। কোনো কোনো দিন মনে হতো বোধ হয় মরেই যাব। এ সময় দুপুরে অল্প একটু নুডলস খেতে দিত। রাতে দিত এক পিস রুটি বা সামান্য নুডলস। এই খেয়ে কি পেট ভরে? খাবারের জন্য কিছু বললে আরও বেশি বেশি মারত।

অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে কয়েক দিন পর তাদের কাছ থেকে মুক্তি পাই। পরে বাড়িতে কথা বলে জানতে পারি, এর মধ্যে আরেকজন দালালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা করে দিয়ে আমাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৮ কি ১৯ নভেম্বর থেকে ফরহাদ নামের সেই দালালের তত্ত্বাবধানেই দিন কাটতে থাকে।

স্থানীয় থানায় জিডি করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমাদের দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলতে থাকে। এর মধ্যেই একদিন ফরহাদ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তওবা কেটে বললাম, আমরা দেশে ফিরতে চাই।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ২৬ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসি আমরা।

পরিবারে আমার মা–বাবাসহ ছোট দুই ভাই ও স্ত্রী। সবাইকে ভালো রাখতেই এই পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমাকে বাঁচাতে আমার পরিবার জমিজমা, সোনাদানা, হালের গরু-ছাগল বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়িটাও বন্ধক রেখে সুদে টাকা নিয়েছে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকেও টাকা ধার নিয়েছে। আমাকে ছাড়িয়ে আনতে ধাপে ধাপে সব মিলিয়ে ৩৩ লাখ টাকা গেছে। এত ধার-দেনা এখন কীভাবে শোধ করব, জানি না।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জীবনযাপন নিয়ে আরও পড়ুন

মাগুরা জেলার অন্যতম বিস্ময়কর প্রাকৃতিক নিদর্শন ঘুল্লিয়া গ্রামের বিশালাকায় বটগাছটি। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই বটগাছটি কেবলমাত্র প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি নয়, বরং এটি স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৫ ঘণ্টা আগে

নিত্যদিনের খাবার সংরক্ষণে একটি অপরিহার্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র ফ্রিজ। বিশেষ করে ব্যস্ত মানুষদের জন্য প্রতিদিনের খাবার কেনা বা রান্না করার সেরা বিকল্প এই গৃহস্থালি পণ্য।

৩ দিন আগে

ইউরোপে গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে চেয়েছিলেন মো. হাবিবুল্লাহ নামে এক তরুণ। কিন্তু এ দেশ-ও দেশ ঘুরিয়ে দালালরা তাকে নিয়ে যায় লিবিয়ায়। সেখানেও এক দালালের হাত থেকে আরেক দালালের হাতে বদল হতে থাকেন। অবশেষে মুক্তিপণ দিয়ে ১০৪ দিন পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন মাদারীপুরের এ তরুণ।

৩ দিন আগে