রাজউকের চোখ এড়াতে পারেনি সাবেক আইজিআর মান্নান

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৫, ১৫: ০৩
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ২০ কোটি টাকার প্লট হাতিয়ে নিতে এসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাতে ধরা পড়লেন নিবন্ধক অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিআর) খান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান।

জেলা জজ থাকা অবস্থায় মূল্যবান এ প্লটের দিকে নজর পড়ে আইজিআর মান্নানের। এরপর তার স্ত্রী দুই ভাই ও দুই সহযোগীসহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এই মিশনে নামেন তিনি। এরমধ্যে প্রায় ৬ কোটি টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। একে অপরের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিতে শুরু করেন তারা। ভেস্তে যায় পুরো মিশন।

সম্প্রতি তাদের মধ্যে আবার রফাদফা হয়। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রাজউকের কাছে সেলস পারমিশন চায়। কাগজ পত্র সন্দেহ হলে সেলস পারিমিশন বন্ধ করে দেয় রাজউক। বিষয়টি এখন রাজউকের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সিদ্দিকুর রহমানের নজরদারিতে রয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

৫ কাঠার এই মূল্যবান প্লটটির সামনে দিয়ে ৬০ ফিট রাস্তা থাকায় উত্তরা আবাসিক এলাকার ৩ নং সেক্টরের ৮ নম্বর সড়কের ৯ নং প্লটির বাজার মূল্য বর্তমানে প্রায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

রাজউকের নথি ঘেঁটে জানা যায়, প্লটটি গত ১৯৬৮ সালের ১৪ নভেম্বর ড. খুরশিদ রেজার নামে সর্বপ্রথম বরাদ্দ দেয়া হয়। বরাদ্ধের পর প্লটের সমুদয় টাকা পরিশোধ করেন তিনি। ১৯৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর লিজ দলিল রেজিস্ট্রি হয়। ১৯৮৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই ৫ কাঠা আয়তনের প্লটের দখলও নেন তিনি। প্লটের চারপাশে বাউন্ডারী ওয়াল দিয়ে টিনশেড ঘর নির্মাণ করে কেয়ারটেকারের মাধ্যমে দখলরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন যাবৎ রোগে শোকে ভোগে অবশেষে ১৯৯০ সালে তিনি মারা যান। ফলে নকশা অনুমোদন নিলেও আবাসিক ভবন নির্মাণ করে যেতে পারেননি তিনি।

জানা যায়, ড. খুরশিদ রেজা বিবাহিত ছিলেন না। একারণে ছিলোনা তাঁর কোনো উত্তরাধিকার । তার সম্পদ দেখবাল করার মত কোন লোকও ছিলনা। এদিকে ভবন নির্মাণের জন্য নকশায় দেয়া সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৯৫ সালের ৯ নভেম্বর তার প্লটের বরাদ্দ বাতিল করে দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

তখন এই প্লট নজরে পড়ে সাবেক এই আইজিআরের। এই চক্রটি দ্রুত নকল কাগজ তৈরি করে প্লটটি দখলের চেষ্টা করেন। চক্রটির প্রধান হোতা আইজিআর মান্নান এ প্লট বাগিয়ে নেয়ার জন্য হেন কোন কাজ নেই যে তিনি করেননি।

জনৈক এক মহিলা জরিনা বেগমকে ড. মো. খুরশিদ রেজার স্ত্রী ও রাশেদ রেজা নামে এক যুবককে পুত্র দাবি করে জেলা জজ আদালতে একটি দেওয়ানি মামলাও দায়ের করেন দেন তিনি। যার মামলা নং- ৮৯/০৫। মান্নানের সহযোগিতায় পরে উক্ত মামলার রায় এই নারীর পক্ষে যায়। ওই রায়ের কপিসহ জরিনা বেগম নামজারি ও দখল হস্তান্তরের জন্য রাজউকে আবেদন করেন। জরিনাকে ড. মো. খুরশিদ রেজার স্ত্রী বানাতে সহায়তা নেন সোনালী ব্যাংক উত্তরা মডেল টাউন কর্পোরেট শাখার। ব্যাংকের নথি ঘেঁটে দেখা যায় মো: আবদুল মান্নান নামে এক ব্যক্তির ০১২৭১০১০২৩২৯০ নম্বরের একাউন্টটি টেম্পারিং করে জরিনা বেগমের নামে দেখায়।

ব্যাংকের এই শাখার ডিজিএম নুরন্নাহারের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই নম্বরের একাউন্টের মালিক জরিনা বেগম নয়। তবে কিভাবে এই স্টেটম্যান্ট সংগ্রহ করেছেন তা আমাদের জানা নেই। অথচ জরিনা বেগমকে স্ত্রী বানাতে এই হিসাব নম্বর ও সিল ছাপ্পরসহ ডকুমেন্টস ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি অফিসে এসব ডকুমেন্টস উপস্থাপন করার প্রমান পাওয়া গেছে। এছাড়া ডা: খুরশিদ রেজার যদি ছেলেই থাকতো তাহলে স্ত্রীর অধিকার পেতে মামলা করতে হবে কেন? ঘুরেফিরে এমন প্রশ্নও আসছে বারবার।

এদিকে জরিনা বেগম ও কথিত ছেলে রাশেদ রাজার কাছ থেকে চতুর আইজিআর মান্নান জমিটি তার কেয়ারটেকার জিয়ায়ুল হক জিয়ার নামে লিখে নেন।

পরে কেয়ারটেকার জিয়াউল হক জিয়া আইজিআর মান্নানের সঙ্গে বেইমানি করে তাকে না জানিয়ে প্লটটি বিক্রির উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী জাকির হোসেন, জুবায়ের আলম ও সজীব আহমেদের কাছ থেকে ২ কোটি টাকা বায়না নেন। বিষয়টি আইজিয়ার আব্দুল মান্নান জানতে পেরে তার স্ত্রী মোসা. শাকিলা বেগম এবং তার দুই ভাই মো. হারুনুর রশিদ খান ও মো. আব্দুল হান্নান খানকে ও প্রতিবেশী আব্দুল হাকীমকে দিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্লটটির হস্তান্তর কায্রক্রম বন্ধ রাখার জন্যই আবেদন করান।

এসব অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, তাদের ভোগ দখলের প্লটটি জিয়াউল হক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ও ভুয়া ব্যক্তি সাজিয়ে প্লটটি অন্যত্র বিক্রয় করার চেষ্টা করছে।

এরপর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে আমলে নিয়ে প্লট হস্তান্তর বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে উপসচিব (আইন কর্মকর্তা-২) আসাদুজ্জামান রিপন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

এদিকে রাজউকের এক কর্মকর্তার সহযোগীতায় কেয়ারটেকার জিয়াউল হকের সাথে আপোষ রফাদফায় যান আইজিয়ার আব্দুল মান্নান। পরে মান্নানের স্ত্রী ও ভাইদের সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু রাজউক তাদের এ চালাকি বুঝতে পেরে সেলস পারমিশন বন্ধ করে দেয়।

এ বিষয়ে রাজউকের এক কর্মকর্তা নিখাদ খবরকে জানান, শুনেছি এঘটনার সাথে রাজউকের এক উপরিচালক জড়িত রয়েছেন। সেলস পারমিশন করিয়ে দেয়ার জন্য তার সাথে ২ কোটি টাকার কন্টাক্ট হয়। হুইল চেয়ারে করে এসে বনানীর এক বাসায় বসে আইজিআর নগদ ২০ লাখ টাকাও দেয় রাজউকের ওই কর্মকর্তাকে। কিন্তু এ টাকা কোন কাজে আসেনি। এসব ঘটনার রাজ সাক্ষি আবদুল হাকিম।

এবিষয়ে হাকিম জানান, আইজিআর মান্নান অতি চতুর প্রকৃতির লোক আমাকে দিয়ে অভিযোগ করিয়ে আবার এ অভিযোগ প্রত্যাহোর করানো হয়েছে। লেনদেন হয়েছে মোটা অংকের। কিন্তু আমাকে এক টাকাও দেয়া হয়নি। সেলস পারমিশন হলে পরে টাকা দেয়ার কথা বলে। রাজউকের সাথে ২ কোটি টাকার কনট্রাক্ট হয়েছে। আশা করা হচ্ছে কিছু দিনের মধ্যে পারমিশন পেয়ে যাবে।

এদিকে বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান অবসরপ্রুাপ্ত মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিখাদ খবরকে বলেন ইতোমধ্যে আমরা হস্তান্তর প্রকৃয়াটি বন্ধ করে দিয়েছি।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

বিশেষ সংবাদ নিয়ে আরও পড়ুন

সারাদেশে বাড়ছে মব জাস্টিস বা উন্মত্ত জনতার বিচার। মব জাস্টিসের নামে যেটা ঘটছে সেটা ভয়াবহ। এটাকে বিচার বলতে চান না কেউ। বিচার একটি পজিটিভ শব্দ। যে বিচারের অর্থ হয়ে উঠেছে গণপিটুনি, অপমান, হত্যা কিংবা আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা। এতে করে বাড়ছে সারা দেশে আতংক।

১ দিন আগে

জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ২০ কোটি টাকার প্লট হাতিয়ে নিতে এসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাতে ধরা পড়লেন নিবন্ধক অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিআর) খান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান।

৩ দিন আগে

এক বহুমুখী প্রতারকের নাম আবু সাদেক। যিনি এসএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত ২ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু তিন দিনের মাথায় তিনি আবার জামিনে মুক্তি পান। ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতিতে প্রশ্ন তোলেন, কীভাবে

৩ দিন আগে

শনিবার মধ্যরাতে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্বের মেয়াদ শেষ হয়। এরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় নতুন করে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকরে রাজি থাকার কথা জানায়।

৪ দিন আগে