ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) থেকে এই আবেদন তিনটি ধাপে ইন্টারপোলে পাঠানো হয়েছে।

যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ চাওয়া হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ,

সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

পুলিশ সদর দফতরের সূত্র বলছে, আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ বা তদন্ত সংস্থার অনুরোধে এনসিবি শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদনটি ইন্টারপোলে পাঠানো হয়।

প্রসিকিউশন জানায়, অধিকাংশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা। তবে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ যুক্ত করে আলাদা আবেদন করা হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। গণঅভ্যুত্থান চলাকালে এবং আওয়ামী শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত মোট ৩৩৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। চলমান তদন্ত ৩৯টি, এবং প্রাথমিক যাচাই শেষে ২২টি মামলায় রূপান্তর হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত ১৪১ জনের মধ্যে ৫৪ জন গ্রেপ্তার ও ৮৭ জন পলাতক। তাদের মধ্যে ৭০ জন বেসামরিক, ৬২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্ত সামরিক কর্মকর্তা।

চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলাসহ চারটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

* গণঅভ্যুত্থান চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতার মামলা

* আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনা

* রাজধানীর চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ড

* রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা ব্যক্তির ওপর গুলি চালানোর মামলা

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ভিডিও ও ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ, যাচাই ও জিও-লোকেশন মিলিয়ে তদন্ত চলছে। ঢাকাসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় ‘গুমকেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিত স্থান- ‘আয়নাঘর’, ‘হাসপাতাল’, ‘এলআইসি’- পরিদর্শন করে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ১৫টি জেলায় তদন্ত দলের একাধিক সফর এবং ৪টি গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে ৮০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এক মতবিনিময় সভায় বলেন, “জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার। সব ঘটনার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আদালতে আমরা তা তুলে ধরতে পারবো।”

প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম জানান, রেড নোটিশ জারির জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি আইজিপির অফিসে পাঠানো হয়েছে, যেখান থেকে ইন্টারপোলের কাছে তা পাঠানো হবে।